Sunday, October 21, 2012

দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং ও প্রযুক্তিগত সমস্যা

বেশ কিছু দিন থেকে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে মোট ১০টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং করার অনুমোদন পেয়েছে। এসব ব্যাংকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সংখ্যা ছিল লাখ ৪২ হাজার ২৮৯ জন। ওই সময় পর্যন্ত এইসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছিল মাত্র ২০৭ কোটি লাখ টাকা। তবে গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের তথ্য অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। আর গত মে মাসের পর থেকে প্রতি মাসে গড়ে লেনদেন হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। জানা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ ডাচ বাংলা ব্যাংকই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বড় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এসব অ্যাকাউন্ট লেনদেনের বেশিরভাগই হয়েছে এই দুটি ব্যাংক মনোনীত ক্যাশ পয়েন্টের মাধ্যমে। তথাপিও প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা কিছু সমস্যার জন্য এখনও এসব ব্যাংকিং গ্রাহক পর্যায়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। বলা যায়, অনেক সমস্যা বিরাজমান এসব ব্যাংকিং সিস্টেমে। অথচ এসব সমস্যা কিন্তু সমাধানযোগ্য।

বিকাশ মোবাইল ব্যাংকিং
মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেনের জন্য একটি মাধ্যম হলো বিকাশ (bKash) ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় দ্রুত অর্থ লেনদেনের জন্য এটি খুবই অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। অনলাইনে কেনাকাটা, ইভেন্ট টিকিট বিক্রি, বিল পেমেন্ট ইত্যাদির জন্য বিকাশ বেশ জনপ্রিয়।
প্রথমত বিকাশ সেবা উপভোগ করার জন্য ব্যবহারকারীকে বিকাশ মোবাইল অ্যাকাউন্ট নম্বরের জন্য বাধ্যতামুলক নিবন্ধিত হতে হয়। মোবাইল অপারেটরের SMS-এর বিকল্প USSD সার্ভিস ব্যবহার করে বিকাশ ব্যক্তি বাণিজ্যিক পর্যায়ে টাকা লেনদেনের এই বিশেষ সেবা দিচ্ছে। এই সেবার মাধ্যমে মোবাইল ব্যবহারকারীরা একে অপরকে সরাসরি টাকা আদান-প্রদান করতে পারে। এছাড়া বিকাশের নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেনও করা যায়।
বিকাশ টাকা জমা উত্তোলন ছাড়াও দুধরনের টাকা প্রেরণের সেবা দেয়। একটি হলো ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থ প্রেরণ (Send Money) অন্যটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিল পরিশোধ (Payment) অর্থ প্রেরণের অথবা বিল পরিশোধের জন্য মোবাইল ফোন থেকে *247# ডায়াল করলে মোবাইল স্ক্রিনে একটি মেনু আসে, যেটা অনুসরণ করে মুহূর্তের মধ্যেই টাকা পাঠানো যায়, যা প্রাপকের নিবন্ধিত বিকাশ অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং প্রাপককে এসএমএসের মাধ্যমে অবগত করা হয়। অতঃপর প্রাপক তার প্রাপ্তি টাকা বিকাশ এজেন্ট অথবা এটিএম মেশিনের মাধ্যমে উত্তোলন করতে পারে।

ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ সার্ভিস
বিকাশের এই অর্থ লেনদেন সেবাটি ব্যক্তিপর্যায়ে মসৃণ হলেও বাণিজ্যিক পর্যায়ে একটি বিশেষ জায়গায় বেশ বিশৃঙ্খল। ধরা যাক ঢাকার এক বাসিন্দা যশোরের কোনো এক পাইকারি নকশিকাঁথা বিক্রেতার কাছ থেকে কিছু কাঁথা কিনবেন। কাঁথা বিক্রেতা তাকে কাঁথার মূল্য বাবদ টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাতে বললেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন, টাকা পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাঁথাগুলো পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। ঢাকার ক্রেতা যথারীতি তার নিজের নিবন্ধিত মোবাইল থেকে বিল পরিশোধ করলেন। যেহেতু বিকাশ প্রতিটি লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি ইউনিক লেনদেন (transaction) নম্বরসহ প্রেরকের মোবাইল নম্বর, প্রেরিত টাকার অঙ্ক প্রাপককে এসএমএসের মাধ্যমে জানায়, সেহেতু বিক্রেতা এসএমএসে উল্লিখিত মোবাইল নম্বর ক্রেতার মোবাইল নম্বরের সঙ্গে মিলিয়ে পেমেন্ট নিশ্চিত করে কাঁথাগুলো প্রতিশ্রুতিমত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন।
ওপরের বর্ণিত লেনদেনটি যদি ঢাকার ক্রেতা বিকাশ এজেন্ট মারফত করতেন, তাহলে কাঁথা বিক্রেতার পক্ষে টাকা প্রেরণকারীকে শনাক্ত করতে বেশ হিমশিম খেতে হতো, কারণ এসএমএসে প্রেরকের মোবাইল নম্বরের জায়গায় বিকাশ এজেন্টের মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা থাকে। উল্লেখ্য, এজেন্ট মারফত টাকা প্রেরণের ক্ষেত্রে এজেন্ট টাকা প্রেরণকারীকে লেনদেনের প্রমাণ হিসেবে একটি ইউনিক লেনদেন নম্বর দেয়, যা পরে লেনদেন শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এমন পরিস্থিতিতে বিক্রেতাকে তার কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার ফোনের অপেক্ষায় থাকতে হয় ইউনিক লেনদেন নম্বর মিলিয়ে পেমেন্ট নিশ্চিত করার জন্য। এমন দুই-একজন ক্রেতার ক্ষেত্রে বিক্রেতাকে তেমন হিমশিম খেতে না হলেও অধিক ক্রেতার বেলায় ব্যাপারটি খুবই জটিল আকার ধারণ করবে, বিশেষ করে -কমার্স সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। এমন অবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তিও তাদের তেমন সাহায্য করতে পারবে না। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই চমত্কার প্রকল্পের পরিকল্পনায় কার্যকর স্বয়ংক্রিয়তা অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা
জানা গেছে, মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক সিটিসেল-এর সাথে যুক্ত হয়ে বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২০১১ সালের ৩১ মার্চ থমবারের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। পর্যায়ক্রমে ব্র্যাক, মার্কেন্টাইল, ব্যাংক এশিয়া, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, "াইম, "াস্ট এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক বিভিন্ন অপারেটরের সাথে যুক্ত হয়ে মোবাইলে ব্যাংকিং সেবা দি"েছ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে "াহকরা টাকা জমা, উত্তোলন, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা বিতরণ, এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন, "বাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আহরণ, সরকারের যে কোনো পরিশোধ, সরকারি অনুদান "াপ্তিসহ বিভিন্ন সেবা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

বিক্যাশের পাশাপাশি ডাচ-বাংলা ব্যাংকও সারাদেশ ব্যাপি মোবাইল ব্যাংকিং চালু করেছে অনেক আগেই। দেশের যে কোনো প্রান্তে টাকা লেনদেনের জন্য বিক্যাশের পাশাপাশি ডাচ-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিংও অন্যতম। বিক্যাশ ডাচ-বাংলা দুটির সেবা কিছুটা এক হলেও এদের ব্যবস্থা কাঠামো প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ আলাদা।
ডিবিবিএল-এর মতে মোবাইল ব্যাংকিং হচ্ছে শাখাবিহীন ব্যাংকিং ব্যাবস্থা, যা বিশেষ করে দেশজুড়ে বাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য। গ্রাহক নিবন্ধনসহ নগদ টাকা জমা উত্তোলন, বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণ, বেতন-ভাতা বিতরণ, আন্তঃব্যাংক টাকা ট্রান্সফার অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স অনুসন্ধান সেবা এই মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে থাকে। নানা সুবিধার মধ্যে এটিকে প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং, সুবিধাজনক, সহজলভ্য, নিরাপদ এবং প্রতারণারোধক বলে দাবি করে এই ডিবিবিএল মোবাইল ব্যাংকিং।
ডাচ-বাংলাও বিকাশের মতো মোবাইল অপারেটরের SMS এর বিকল্প USSD সার্ভিস ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস তার গ্রাহকদের দেয়। অবশ্য এই সার্ভিসের আরেকটি অংশে আইভিআর (IVR) ব্যবহারিত হয়। যেহেতু মোবাইল অপারেটর কর্তৃক প্রচলিত এই SMS এর বিকল্প USSD সার্ভিস ডাটা সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে না, তাই ডিবিবিএল মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দাবি করা সেবাগুলো, নিরাপদ এবং প্রতারণারোধক তা বিবেচনায় প্রশ্ন রাখে। যদিও অনলাইন ব্যাংকিং বলতে এখানে কী বোঝানো হয়, তবে বিশ্বমানের ব্যাংকিং অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংকে প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং বলে দাবি করা যায় না।
কেননা মোবাইল ব্যাংকিং অবশ্যই সিকিউরড/নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হতে হয়, যা গ্রাহকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। কারণেই উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলো কখনই টাকা লেনদেনের জন্য মোবাইল অপারেটরের SMS অথবা এর বিকল্প USSD সার্ভিস ব্যবহার করে না, তবে কিছু কিছু ব্যাংকের মাধ্যমে শুধু ব্যালেন্স অনুসন্ধান অথবা মিনি স্টেটমেন্ট জাতীয় সেবা দিয়ে থাকে, যেখানে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কম থাকে বা একেবারেই থাকে না বললেই চলে।

ডিবিবিএল বিকাশ সেবার ঝুঁকিসমূহ
গ্রাহক তার সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাঝে মোবাইল ফোন অপারেটর সার্ভিস প্রদানের জন্য মিডলম্যান হিসেবে কাজ করে। এর ফলে মাঝখানের কোনো এক অসাধু ব্যক্তি চাইলে নানা ধরনের প্রতারণা করতে পারে, কেননা গ্রাহক তার সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাঝে আদান-প্রদান করা তথ্য সেই অসাধু ব্যক্তির পক্ষে পড়া সম্ভব। যদিও বাংলাদেশে যেসব ব্যাংক তথাকথিত ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকে, তারা এই প্রতারণা রক্ষার্থে ইন্টারনেট ব্রাওজারে নিরাপদ বা সিকিউরড সকেট ব্যবহার করে থাকে, যা এসএসএল (SSL) নামে পরিচিত, যাতে এই সেবা ব্যবহারকারী প্রদানকারী ব্যতীত মাঝখানের অন্য কেউ কোনো ধরনের তথ্য পড়তে সক্ষম না হয়। তারপরও সফিক প্রেরক চিহ্নিত করা কঠিন।
ধরুন, ঢাকার কোন ব্যাক্তি টেকনাফে অবস্থানরত তার ভাইয়ের পাঠানো টাকা তুলতে ব্যাংকের কোন এক ব্রাঞ্চে গেল। ব্যাংকে গিয়ে তাকে প্রেরকের মোবাইল নম্বরে সাথে অতিরিক্ত একটি নম্বর (যা প্রেরকের একাউন্ট) বলতে হয় যা তার ভাইয়ের একাউন্ট। এরপর সেই ব্যাংক থেকে একটি মেসেস পাঠানো হয় প্রেরকের নম্বরে। এরপর ওই নম্বর থেকে কনফারমেশন মেসেস আসার পরই ব্যাক্তিকে অর্থ প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, একাউন্টধারী ব্যাক্তিটির কাছে শুধু একটি মেসেস যায়। মেসেস প্রাপকের কোন তথ্য, পরিচিতি বা প্রাপকের মোবাইল নম্বর উল্লেখ থাকে না। সমস্যাটা হলো, একই সময়ের দুই বা পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে অন্য কোন ব্যাংকে কোন অসাধু ব্যাক্তি ওই নম্বর বলে টাকা তুলতে চাইলে কিন্তু প্রক্রিয়ায় সে টাকা তুলে ফেলতে পারে। এখানে ব্যাংক কিন্তু সঠিক লোককে চিহ্নিত করতে পারছে না। এসব সমস্যা বিরাজমান থাকলেও এটা কিন্তু সমাধান যোগ্য।

সমাধান যা হতে পারে
ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট কনফারমেশন : টাকা বা পেমেন্ট প্রাপকের জন্য এসএমএস ছাড়া অথবা এর পাশাপাশি এমন একটি নিরাপদ বিকল্প ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট কনফারমেশন পদ্ধতি থাকতে পারে, যেখান থেকে প্রাপক রিয়েল টাইমের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রেফারেন্সসহ শনাক্তকরণ পেমেন্ট বা টাকা প্রাপ্তির তথ্য পাবে এবং লেনদেনের বিস্তারিত তাদের তথ্যভাণ্ডারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে।
মোবাইল ব্যাংকিং/টাকা লেনদেন : অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সিকিউরড/নিরাপদ ডাটা আদান-প্রদান অপরিহার্য। দেরি হওয়ার আগেই শুধু ব্যালেন্স অনুসন্ধান অথবা মিনি স্টেটমেন্টের মতো সেবা ছাড়া অতিসত্বর মোবাইলে এই অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা নিরাপদ পদ্ধতির প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা বাঞ্ছনীয়।
ভোক্তা সুবিধা অধিকার নিশ্চিতকরণে বিটিআরসি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। মুলত: একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা তার বাস্তবায়নই সব ধরনের জটিলতার অবসান ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা সহায়ক হতে পারে।

No comments:

Post a Comment